ব্রেকিং নিউজ

img/news-single-img/post-img-01.jpg

বিশেষ প্রতিবেদনঃ হাজার হাজার বছর ধরে সারা পৃথিবীতে হাতে বোনা কাপড়ের ব্যবহার ও কদর হয়ে আসছে। সেই হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতার সময় থেকেই হাতে বোনা কাপড়ের প্রচলন। যদিও বর্তমানে ফ্যাক্টরিতে তৈরি হাওয়া কাপড়ের চাহিদাই বাজারে বেশি কিন্তু হাতে বা তাঁতে তৈরি কাপড়ের আবেদন ও মূল্য এখনো অনেক বেশি।বস্ত্র প্রস্তুত করার এই পদ্ধতি বেশ সময় সাপেক্ষ ও কঠিন প্ররিশ্রম সাধ্য ,সেই কারণেই হাতে বোনা কাপড়ের চাহিদা বাজারে থাকলেও সেই পরিমান যোগান নেই আর সেই জায়গা ভরাট করেছে বর্তমান ফ্যাক্টরি জাত  আধুনিক বস্ত্র  ,তবে ইদানিং কালে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্প শুরু হয়েছে এই প্রাচীন বস্ত্র শিল্পকে নতুন করে প্রচার ও উন্নত করার জন্য যাতে আমাদের এই শিল্পের সাথে যু ক্ত মানুষেরা অনুপ্রাণিত হন ও এই ঐতিহ্য আরো গৌরবময় হয়ে ওঠে।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে হাতে বোনা কাপড়ের গুরুত্ব অন্য যেকোনো দেশের থেকে বেশি ,তার প্রধান কারণ হলো কবির ভাষায় ,'না না ভাষা নানা মত নানা পরিধান ,বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান ' অর্থাৎ সারা বিশ্বে আর কোথাও একই দেশের মধ্যে এতো বৈচিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই বৈচিত্রের ছোঁয়ায় আমাদের দেশের বস্ত্রও অনন্য, এক একটি শিল্প কলা ,বর্ণ,কারুকার্য ,সুতো সবই একে ওপরের থেকে আলাদা তাই গোটা বিশ্বের দরবারে ভারতের বস্ত্র শিল্পীদের হাতে তৈরি কাপড় আজও বিখ্যাত। এছাড়া ,দেশে যখন স্বাধীনতার লড়াই চলছে তখন ১৯২০ সালে গান্ধীজির খাদি আন্দোলন  খাদিবস্ত্র  বা বস্ত্র বুনন কে মানুষের সামনে তুলে ধরেন এবং ১৯২১ সালে তিনি কুমিল্লার চান্দিনা  অঞ্চলে বিদেশী কাপড় ছেড়ে দেশি কাপড় ব্যবহারের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন ,তার ডাকে আসমুদ্র হিমাচল সাড়া দেয় ও সেই সময় থেকেই বস্ত্রবুনন শিল্পে একটা জোয়ার আসে,সেইদিন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত গান্ধীজির অবদান অন্য সব ক্ষেত্রের মত ভারতীয় বস্ত্র শিল্পেও অনস্বীকার্য।

 

ভারতে প্রচলিত বিভিন্ন হস্তবুনন পদ্ধতি 

আমাদের সমগ্র দেশের সংস্কৃতির ছায়া আমাদের বস্ত্র শিল্পে প্রতিফলিত হয় ,দেশের প্রতিটি কোনায় কোনায় প্রতিভাবান শিল্পীরা আছেন যারা নিজেদের হাতে অপূর্ব সৃষ্টিকলা কাপড়ের মধ্যে ফুটিয়ে তোলেন এবং আমরা সেই অসাধারণ শৈলীতে মুগ্ধ হই।সেই রকমই কিছু হাতে বোনা বস্ত্রশিল্প নিয়ে কথা বলা যাক -

কলমকারী (অন্ধ্রপ্রদেশ ) -এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি অঙ্কন শিল্প যা সাধারণত শাড়ী ,ওড়না ইত্যাদির ওপর কলম বা পেন দিয়ে করা হয়।

 

মুগা সিল্ক (আসাম )- সিল্ক শাড়ির জগতে অন্যতম নাম হলো মুগা সিল্ক ,এটি হালকা সোনা রঙের জরি দিয়ে তৈরি হয় এবং মেখলা ও শাড়ীই এই সুতোয় তৈরি হয়।

 

ভাগলপুরে সিল্ক (বিহার): এই সিল্ক আসলে তসর সুতোয় তৈরি হয় এবং এর থেকে তৈরি শাড়ি গোটা দেশে বিখ্যাত।

 

বন্ধনী(গুজরাট ): এটি একটি বিখ্যাত বস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া ,কাপড়কে বিশেষ ভাবে বেঁধে রং করা হয় বলেই এর এমন নাম ,বন্ধনী শাড়ি ,কামিজ সবই জনপ্রিয়।

 

সম্বলপুরী শাড়ি (উড়িষ্যা ): সম্বলপুরি কাপড় মহিলাদের মধ্যে খুবই বিখ্যাত ,এই কাপড় নানা রকমের হয় যেমন,সোনপুরী ,বোমকাই,বাপ্টা ইত্যাদি।

 

বেনারসি সিল্ক (বেনারস) : ভারতে ও বিদেশেও এই সিল্কের জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়া,সেই রাজা মহারাজাদের আমল থেকে এই সিল্কের কদর ,যেমন বিখ্যাত তেমনই দামি এই সিল্ক তবে বিয়ের সময় বিশেষ করে বাঙালিদের বিয়েতে এই সিল্কের শাড়ি অনিবার্য।

 

তাঁতের কাপড় (পশ্চিমবঙ্গ ): সুতির সুতোয় তাঁতেবোনা কাপড় পশ্চিমবঙ্গে  বিখ্যাত , যেকোনো ধরণের সুতোকেই তাঁতে বুনে কাপড় তৈরির এই পদ্ধতি অনেক প্রাচীন। সিল্ক,তসর ,মলমল সব ধরণের সুতোকেই তাঁতে বুনে কাপড় তৈরি করা হয় কিন্তু তাঁতের কাপড় বলতে সাধারণত সুতির সুতোয় প্রস্তুত কাপড়কেই বলা হয়। এছাড়া ,জামদানি,বালুচরি,বাটিক ইত্যাদি আরো নানা ধরণের বুনন পদ্ধতির জন্য পশ্চিমবঙ্গ বিখ্যাত।

 

ভারতে বস্ত্র বুনন হস্তশিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি আগামী সম্ভাবনা : ভারতের অর্থনীতিতে  বুনন হস্তশিল্প বিরাট স্থান অধিকার করে আছে ,কারণ কৃষি কাজের পরে বস্ত্র বুনন হস্ত শিল্পেই অধিকাংশ মানুষের রুজিরুটি জড়িত। প্রায় ৭০ লক্ষ  মানুষ এই কাজের সাথে জড়িত যার মধ্যে অধিকাংশই নারী। ভারতের মত দেশে  যেখানে গ্রামে  ও শহরে অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে সেখানে খুব সহজেই বস্ত্র শিল্পের ফ্যাক্টরি গুলোতে কাজের জন্য শ্রমিক পাওয়া যায় কিন্তু বুনন হস্ত শিল্পের শিল্পীরা যারা এই শিল্পকর্মকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলছেন তাদের অবস্থা সময়ের সাথে সাথে অর্থের ও সহযোগিতার অভাবে  শোচনীয় হয়ে পড়ছে। অবশ্য এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রকল্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে এই সকল মানুষ যারা হস্ত বুনন   শিল্পের সাথে বংশপরম্পরায় জড়িত তারা নিজেদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার পান এবং তাদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন হয়।

 

The Associated Chambers of Commerce and Industry of India ( ASSOCHAM )  এর ২০১৭ সালের একটি গবেষণায ''Women in Textiles & Handicrafts Industry'  প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়  যে আগামী দুই বছরের মধ্যে বস্ত্র শিল্পের সূচক  প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলার ছোঁবে,যার অর্থ ভারতের GDP এর ৫% ও রপ্তানি শিল্পে ১৩% উপার্জন হবে এর থেকে। কিন্তু এর মধ্যে বুনন হস্তশিল্প অনেকক্ষেত্রেই অবহেলিত তাই এখন বিশেষ চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে হস্ত শিল্পের হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।সরকারি ও বেসরকারী বহু সংস্থা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হস্ত শিল্প মেলা ,ওয়ার্কশপ ইত্যাদি করে এবং এতে গরিব কৃষক বা শিল্পী যারা কাঁচা মাল প্রস্তুত করা  থেকে শুরু করে বুনন শিল্পের বিভিন্ন কাজ করেন তারা কিছু অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হন এবং তাদের গুনের কদর হয়। দেশ বিদেশে এই সব পণ্য রপ্তানি করা হয় এবং তার থেকে  বিদেশী অর্থ আসে যা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরো মজবুত করে।

 

ভারতবর্ষ চিরকালই শিল্প ও স্থাপত্যের দেশ ,কিন্তু কালের নিয়মে আমাদের দেশের হস্তশিল্প ও শিল্পীরা পিছিয়ে পড়েছেন এবং তাদের শিল্প সৃষ্টি আধুনিকতার আলোয় অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত আমাদের দেশের এই ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টা করা ,মনে রাখতে হবে যখনি আমরা কোনো হস্তশিল্প দ্রব্য কিনি তখন আমরা শিল্পীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথের অংশীদার হয়ে উঠি তাই যত সম্ভব হস্তশিল্প জাত দ্রব্য কিনুন এবং অন্যদেরও উৎসাহ দিন,তবেই একদিন আমাদের দেশ সব দিক দিয়ে কাঙ্খিত উচ্চতায় পৌঁছবে।

 

তথ্য সূত্র :  https://www.business-standard.com

                 https://marigoldliving.com/

You Might Also Like

Our Newsletter

স্কিল নিউজ